Sunday 18 August 2013

মানচিত্র পেরিয়ে - অনিন্দিতা গুপ্ত রায়




মানচিত্র পেরিয়ে
-অনিন্দিতা গুপ্ত রায়



            পৃথিবীর নাকি তিন ভাগই জল। তো পাগল সেটা জানে। মানে ও তো আর জন্ম ইস্তক পাগল নয়, আর ও যে পাগল সেটাতো আর ও জানেনা... অন্যেরা জানে। তা ওরা তো আর এটা জানে না যে পাগল আসলে অল্প অল্প সবই জানে। এই যেমন এই যে শরীরটা এত পরিপাটি করে ফিটফাট করে ফুলবাবুটি হয়ে থাকো তোমরা, তোমাদের সবার মধ্যেই এক দাঁতখিঁচোনো হাড্ডিমানুষ বসত করে, ও জানে।  ওর পেটের মধ্যেও মাঝে মাঝেই অমন তিন ভাগ জল থই থই করে। দুখান বিস্কুট বা একগাল মুড়ি দিয়ে সিকি ভাগ স্থলে ও ত দিব্যি চালিয়ে নিচ্ছে এতকাল। আজ পাগল আলোর গল্পটা বলছিল । সে নাকি অনেক জন্মের আগের কথা। চোখ বন্ধ করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে নাকি চেনা ঠেকে তাকে। দেখলে পরে হবে না, ছুঁয়ে দেখতে হবে। যেমন করে জোছ্‌না দ্যাখো, যেমন করে রোদ্দুর, যেমন করে আগুন, তেমন করে,তেমনি করে। কত জন্ম আগের কথা বলে পাগল কে জানে। জানলার পাশে সারাদিন পর যেমন করে সন্ধ্যাতারা , তেমনি পাগলও তার গল্প মাথায় হাজির। একেকদিন একেক জিনিস ফিরি করে সে। কাল এনেছিল জলের গল্প, সমুদ্দুরের, আর একটা নৌকো আঁকছিলাম সারাদিন। আয়ত চোখের মত সজল, বাঁশপাতার মত ছিপছিপে। মেঝের ওপর বিছানার  নিচে কিরকম স্রোত স্রোত ঢেউ ঢেউ আর সীগালগুলোর উড়ে আসা। ছুঁয়ে ছুঁয়েই দেখছিলাম, শুয়ে শুয়ে ।আর সত্যি সত্যি খুবচেনা,গতজন্মেরযা বলছিলাম, পাগল আজ হাঁক পাড়ছে -আলো নেবে গো  আলোওওওওওওওওওও....একটা গান বেজে উঠছে।   এক্ষুনি একটা বিষাদমাখা রং উপচে উঠে ডানার   মত কিছু একটা মেলে দেবে নিজেকে...আস্তে আস্তে পাখনার মত হয়ে যাবে আর হুইল চেয়ারটার দুপাশে এসে জুড়ে যাবে।  কোত্থাও কোনও হাওয়া নেই অথচ আলোপথ ছায়াপথ পেরিয়ে উঠে যাবে নীলের মত অতলান্ত ভেদ করে ...চাকাওয়ালা একটা স্পেসশিপ্‌ । মুখের একপাশটায় অন্ধকার, অন্য পাশটায় আলো । ঠিক যেন পৃথিবীর দুই গোলার্ধ ।  পায়ের তলায় স্পষ্ট  তিন ভাগ জল , এক ভাগ স্থল....আর ওই ডাঙাটার ওপর দাঁড়িয়েই পাগলটা জন্মান্তরের গল্প বলে যাচ্ছে...কর গুনেগুনে..... এসাইলামের ঘন্টা গুলো শোনা যাচ্ছে গ্যালাক্সি ছাড়িয়ে ..আলো নেবে গো...আলোওওওওওওওওওও ..........।     

ডি মেজর - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়



ডি মেজর
-অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়


আমার ডি মেজর ফুরিয়ে আসছে আমার কুসুমে, ডিমে জ্বর এসেছে জ্বরে এই দেশ অরণ্য গৃহকোণ, কোণে সে কোণে যাওয়ার মেঝে, মেঝেয় ফেলা পা,পায়ের জন্য লাথি,সে- তো পায়েই রাখা বেডকভারের প্রান্ত থেকে যখন তখন বেরিয়ে আসবে পাগলা হাতির দঙ্গল-এর মতো লাথিও কখন বেরিয়ে আসবে পায়ের প্রান্ত থেকে,বেরিয়ে আসবে একা না-কি দঙ্গল বেঁধে, আমি তো দূর, পা তা নিজেও জানে না

গায়ের হাওয়ায় ঝুলে আছে ঘর ঘরের কোনো কোণ আমি কেন দেখতে পাই না!

বাড়ির পাশে রাস্তা, রাস্তায় ফেরিওলা, ফেরিওলার পা রাস্তায় পড়ছে, হাঁকছে, ডি মেজরে হাঁকছে, পাড়ায় কেউ ডি মেজর জানে না, ফেরিওলা ডি মেজর জানে না, তবু ডি মেজর থাকে, সঙ্গে থাকে সঙ্গে থাকা মানে কি? কোকিলের সঙ্গে যেমন কুহু থাকে, সেরকম থাকা?   

বৃষ্টির মতো ঘরের মেঝে ঝরছে দেয়ালের গলা অবধি মেঝে দেয়ালও তো মেঝে একজন শুয়ে একজন দাঁড়িয়ে সবসময় ওরা মিলনরত অবস্থায় থাকে সবসময় ওরা চুমু খেয়ে থাকে মেঝে চুমু খায় দেয়ালের পায়ে ওরা চুমু খায় লে ঘর থাকেদাঁড়িয়ে থাকে ঘরে আমি থাকি ঘরে তুমি আসো স্বপ্ন দেখি, ঝগড়া করি, ভাব হয়, রান্না হয়, ঝোলে লবণ বেশি হয়ে যায় সব যুদ্ধ সব প্রেম মেঝের ওপরে দেয়ালের পাশে

ঘরের বাইরেও ঘর গাছের দেওয়াল, মাটির মেঝে সবাই সবাইকে প্রাণপণে ছুঁয়ে আছে রান নিতে মরিয়া দৌড়ে যেভাবে ব্যাটসম্যান ঝাঁপিয়ে স্ট্যাম্প ছুঁয়ে থাকে
 
পুরনো চশমার পাওয়ারে ফেলে আসা দৃষ্টি, জামায় লেগে থাকা হলুদ দাগের মতো তার কাঁচে লেগে থাকা দৃশ্য, তারা কি এখনো কথা বলে সেদিন কি দেখেছিল, দেখেছিল যেন জল অন্তঃসত্ত্বা, তাই তার পেট,তাই তার ঢেউ

চশমার ভাষা আমি জানি না, দেয়ালের ভাষা, মেঝের ভাষা, পায়ের ভাষা জানি না ডি মেজর জানি সেই সুরে কোনো কথা এসে বসলে আমি দেখতে পাই তারে এসে বসেছে লেজ ঝোলা ফিঙে

ফিঙের ভাষা আমি জানি না

  

ভাষাহীন রথযাত্রা - অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়



ভাষাহীন রথযাত্রা
-অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়

অবাধ্য বলে কিছু হয় না। এই ঝিলের কাছে এসে দাঁড়ালে গোটা পাড়াটাকেই আমার দেবতা মনে হয়। নিরাকার মনে হয়। সামান্য যে কয়েকটা ছায়া আর ছায়ামানুষ এখনও জলে ডুব দিচ্ছে তাদের শুধু ধরে রেখেছে চারপাশের অন্ধকার গুলি। কিছুটা স্পষ্ট অস্পষ্ট নিয়ে এই সিদ্ধান্ত আমাকে প্রতিদিনই মঞ্চে তুলে দেয় পারের গন্ধ পেতে। স্থির জলে মাছের ল্যাজের সামান্য নড়াচড়া মেপে নিতে।

এতটা সময় পেরিয়ে যাবার পরেও ওরা এলো না। কবিতাও না। আশা ছিল আজ হয়তো দেখা হবে কারণ দিনের প্রচুর বৃষ্টি আর বিকেলের থেমে থাকা গলিপথে বহু মানুষের চোখে চোখ রেখেও আমি ওকে দেখতে পাই নি। শুধু খুঁজতে খুঁজতে আরোগ্যের একটা কান্নাচোখ আর সেই চোখের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখন মায়ের গন্ধ। আর লেপ্টে থাকারা।

বিশ্বাস বলতে এটুকুই। ভাল হয়ে ওঠা বলতে এক দৌড়ে ফিরে পেতে চাওয়া শাড়ি সোহাগ আর রেখে যাওয়া ডাইরীটা।

রাতের আলোরা আরও জোরালো হয়ে উঠছে ক্রমশ। ঝিলের বাচ্চারা উঠে আসছে ডাঙায় হাতের গ্যালারিতে পদাবলি এঁকে দিতে। আমি ওদের দূর থেকেই দেখি। দেখতে দেখতে ভুলে যাই এই ঝিলটা একদিন পুকুর ছিল। তারও আগে হয়তো ডোবাই ছিল।আর এই ডোবানো প্রলাপে ছিল ঠোঁট। ফেরতের কিছু কিছু সাঁতারও

ঘরে ফিরে এসে জানালায় উঁকি দিলাম। পর্দা সরানো আছে আগের মতো। দরজাটা সেই ভেজানো কিন্তু খোলা খোলা ভাব।           

টিভি তে গান চলছে

কিছুটা শুনতে পাচ্ছি তাকে মহল্লার ইশারায়। পায়ের দিকে তাকালাম। সকলেই তাকায় অভিমান হলে। রক্ত ঝরলে। আমিও কি তার বাইরে ছিলাম? না ভেতরে?

ঝিলের বাচ্চারা এতক্ষণে আমার কাছে পৌঁছে গেছে। ওদের মা বাবারা ঘুমোচ্ছেন মাছেদের পাশাপাশি। এই রাতবাড়ির খেলায় ওকে কাছে পাওয়াটা ভীষণ মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল আর একবার যদি এই ঝিলেই ফিরে পাওয়া মানুষটার জন্য কোথাও জমিয়ে রাখা যায় চুলের কিনারে কিনারে সামান্য কিছু পাথর

যারা আমাদের রথযাত্রা শেখাবে... শেখাবে গড়ানো বাড়িদের কোথাও এখনো লেগে আছে মলাট।

লেগে আছে মোরোগ সংলাপ।