Tuesday 17 September 2013

হোমারা - অলোকপর্ণা



হোমারা
-অলোকপর্ণা

আয়, আজ গাছের কাছে বসি। ছায়া পাই,
আরাম পাই,
শান্ত হয়ে পড়ি।
শান্ত হই।

মানুষগুলোর শিকড় নেই কোনো। ওদের মাংসল পদ গজিয়েছে, তাতেই ঘষে ঘষে ওরা অনেক উঁচুতে দেওয়াল বেয়ে উঠছে কেমন দেখ, দেওয়াল বেয়ে!- ওদের শামুক শামুক লাগছে। আমার পেট থেকে বরং আমি বেরিয়ে আসি। এসে নেমে যাই নিচে, অনেক নিচে, গাছের কাছে নেমে আসি, গাছের কাঁধে হেলান দিয়ে বসি, মহাভারত পড়ি, পড়ি রামায়ণ, জোরে জোরে বলি, জল পড়ে তাই পাতা নড়ে, হিসেব এতটাই সোজা এইখানে,- নিচের দিকে।

আমার পেট থেকে তাই আমি বেরিয়ে এলাম।
নিজেকে বাঁচাতে আমি এটাই করে থাকি- নিজের থেকে বেরিয়ে এসে নিচের দিকে নামা। আমি চোখ খুলি না, কাঁপতে কাঁপতে পৃথিবীর দিকে পিঠ পেতে আমি নামতে থাকি। কাঁপা শব্দের চন্দ্রবিন্দুর আকারে ভেসে থেকে আমি শুনি, পাশের ঘরে তখন বউয়ের হাতে মার খাচ্ছে আমার প্রিয়জন।



আয়নাটা বসাও আগে, তবে না দেখা! তবে না দেখতে শেখা!
স্বপ্নের মধ্যে এক শ্বেতাঙ্গিনী পরিষ্কার বাংলায় একথা বলে চলে গেলেন, আমার ঘুম নিয়ে। আমি ঘুমের ঝিনুক কুড়িয়ে কুড়িয়ে তাঁর পিছু ঢুকে পড়ছি আয়নাবনে আয়নারা স্যুট পরে দাঁড়িয়ে, ওদের মুখ ব্ল্যাংক, সেখানে যেন শুধু আমার মুখ বসার অপেক্ষা। আমি মুখ বসালাম... বসল না। আমি জোর করে বসাতে চাইছি আমার মুখ, বসছে না... বসছে না... আমি আবার গুঁটিয়ে আসছি। গুঁটিয়ে শব্দের চন্দ্রবিন্দুর আকারে শামুকের পতনে পড়ে যাচ্ছি নিচে, পৃথিবীর দিকে। পাশের ঘর থেকে মুহুর্মুহু আয়না ভাঙার আওয়াজ আসছে। আয়না ভেঙে ফেললে মুখ দেখা যায়না, দেখতে পারা যায়না- বলতে বলতে আমি অনেকটা ডুবে আসলাম।
অথচ তুই বললি মুখ দেখার দরকারই বা কি! বলে সেই যে বুজলি চোখ, আমি আর পেলাম না তোকে, তুই রাতারাতি পালক হয়ে গেলি, অথচ তোকে আমি দাদাভাই বলে ডেকেছি।

গাছের কাছে যাও, যাও পাখির কাছে, শিখতে হলে, ওদের কাছে শেখো
গাছকে নিয়ে গোটা উপন্যাস লেখা যায়, জানিস? ওরা ফরিস্তা, উপহার দেবে বলে এক এক করে নেমে এসেছে দুনিয়ায়, কাজ শেষ হলে নির্বাক উঠে যাবে, অদৃশ্য উচ্চতায় উঠে ওরা ডানা মেলবে, ওরা হোমা পাখি হয়ে যাবে। তুই যে গাছ দেখিস, ওরা কিন্তু হাত পেতে আছে, তাই তো বলি হাত পাতা আকাশের দিকে ওরা হাত তুলে দাঁড়িয়ে, শয়ে শয়ে হোমা পাখি লুফে নেবে বলে,- হাসছিস? তোর হাসি থেকে শয়ে শয়ে পদ্ম নেমে আসছে আকাশ থেকে, বিকেলের মেঘ গোলাপি হতে শিখছে।

আমাদের উরুতে আগুনের দাগ লাগা।
ফায়ারপ্রুফড হয়ে এসেছি দুজন, পোড়া গন্ধ আমাদের পালকের শরীরে বাবা পালক গায়ে অফিস পরে আছে, মা ডাল ঢালছে নিপুণ হাতায় আমাদের ছোটবেলায়। আমি বল করছি, তুই ব্যাটে ঠেলে আমার দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছিস আমার ছেলেবেলা, ঘুরে ফিরে আসছে মাঝি তোর রেডিও নাই বইল্যার জোয়ার, আমি অঞ্জন চিনতে শিখছি, নচিকেতা মারছি, ঘুরে ফিরে রিমিক্সড গান আর রবীন্দ্রনাথ ইঞ্জেক্ট করে দিচ্ছিস তুই আমার মধ্যে। আমি তোর মধ্যে বিশ্বরূপ দেখছি। গান দিচ্ছিস তুই আমায়, আমার জীবনে গান ঢুকিয়ে দিচ্ছিস।

আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা...
তোর প্রথম শব্দ বেগিন্দ নাথ! কোন এক দাড়িওয়ালা রিক্সাচালককে দেখে তুই বলেছিলি, মা বলে। আমি এসব বলিনি, আমার স্মৃতি পালকের মত হালকা, উড়ে উড়ে কোন বয়সের পাশে ছড়িয়ে আছে কে জানে, তাই মনে পড়েনা, শিমুল তুলো বুনতে ভাল/ ঠান্ডা জলে নাইতে ভালর পর কি ছিল! সবার চাইতে যে কি ভালো ছিল সেটা আর মনে পড়ে না। তোর পড়ে? এরকম শুধুই নিচে পড়ে যাওয়ার থেকে, সবচেয়ে ভালো কি ছিল, দাদাভাই?
আমার রবীন্দ্রনাথ হলেন। আমার জীবন হল। হোমা পাখির জীবন। পা তৈরি হল না, মাটিতে পড়ার, তাই একদণ্ড শান্তি দেওয়ার বনলতা হল না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হলেন। বিস্ময়বোধকের মত, অশান্তির মত আমার জীবনের পাশে বসে পড়লেন। আমিও তলিয়ে যেতে শুরু করলাম।

এই উচ্চতায়, যাকে হয়ত কেউ ট্রপোস্ফিয়ার বলবে, এখানে অনেক বইয়ের পাতা খোলা। কোনোটা শরৎ, কোনোটা অরুনেশ, কোনোটা বা বিকসেল, মার্কেজ। এক পাতাও পড়া হয় না, পতন রোধ করার জন্য আমি এই বই হাতরাই, ঐ পাতা আঁকড়ে ধরি, শিকড় খুঁজি বইয়ের কাছে। বইয়েরা যে গাছই, জানিস তো? তাই তো ওদের গায়ে এত পাতা, তাই তো ওদের অক্ষরে অক্ষরে কত ফুল, কত ফল। পাতায় পাতায় না হলে কিসের লোভে গর্ত খুঁড়ে রাখে পোকারা? কিন্তু আমার পড়া হয় না, প্রবল ডানা ঝাপটিয়ে একবার স্যাফোর কাছে যাই, আবার ফিরি সন্দীপনের কাছে, এমনই আরো অনেককে ছুঁয়ে নীচে পড়তে থাকি অবিরত... এই পতনের শেষ নেই কোনো, তাই হয়ত এত শূন্যতা, মনে পড়ে তুই গাইছিস, তোমার শেষ নাহি তাই শূন্য সেজে শেষ করে দাও আপনাকে যে,

দাদাভাই, শেষ হওয়ার লোভেই কি এই পতন? পতনের প্রতিও লিপ্সা আমার! রবীন্দ্রনাথ হঠাৎই পাশ ছেড়ে উঠে চলে যান, যেন এই স্তব তাঁর মনোঃপুত হয়নি। এইবার আমি একা হয়ে আসি, প্রকৃত একা হই। ভালো হওয়ার লোভে একা হই, ভালো হয়ে ওঠার লোভে একা হই। হোমা পাখি হই, নিচে নামতে নামতেও খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসি। ডানায় ভর করে উঠতে চেষ্টা করি, অদৃশ্য উচ্চতায়, গাছেদের ডালে বসার আশায় আমার একটি মাত্র ডানা মেলে ধরি। অনেক উঁচুতে গিয়ে নিজেকে প্রসব করি।
আমার গর্ভ থেকে আমিই বেরিয়ে এসে বারংবার নিচে নামতে থাকি।

শব্দের আলমারি - শতাব্দী চক্রবর্তী



শব্দের আলমারি
-শতাব্দী চক্রবর্তী

লোকটা পাশে এসে বসাতে মেয়ে একটু সরে বসল প্যান্ট গোটান, পায়ে কাদাভরা হাওয়াই চটি, হাতে বাজারের ব্যাগ এই ব্যাগের অন্য কোন নাম থাকলেও সে জানে না তাদের বাড়িতে ওই ব্যাগে করেই বাজার আনা হয়, কি অবহেলায় ঝুলতে থাকে ব্যাগ গায়ে তার কত দাগ, কালশিটে সব্জি খসা রস, ছাগল-মুরগি-মাছেদের রক্তের ছোপ মাছ কাটা বঁটিটার কষ্ট কিম্বা যে কাটে তার রক্তের ছাপ আছে কিনা জানে না সে শুধু দেখেছে বাজার ঢেলে নেওয়ার পর, ছুঁড়ে সিঁড়ির উপর ফেলে দেওয়া হয় ব্যাগ, অযত্নে বেড়ে ওঠা বাচ্চাদের মতো রোদ খায় শুকিয়ে ওঠে তারপর তাকে সিঁড়িঘরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় সিঁড়িঘর মানে যেখানে কেউ যায় না নামী-দামী লোক বা নেহাতই বাইরের লোকদের থেকে আড়াল করা হয় তাকে তো এইরকমই একটা ব্যাগ হাতে লোকটা পাশে এসে বসাতে মেয়ে যে সরে যাবে, এই স্বাভাবিক সেই স্বাভাবিকের ওপর ভরসা রেখেই মেয়ে সরে গিয়ে তার বকফুল সাদা ব্যাগ থেকে ম্যাগাজিন বের করল অবশ্যই লিটল

পড়ছে মেয়ে আর আড় চোখে দেখে নিতে চাইছে ব্যাগওলা মানুষকে চোখ কি ফোলা-ফোলা, লাল-লাল? মুখ দিয়ে গন্ধ বেরোবে? পায়ের লোমগুলো দেখে শিউলি গাছে জমে থাকা শুঁয়োপোকাদের মনে পড়ে এই দেখা, ভাবনাদের নিয়ে চোখ চালাচ্ছে মেয়ে তার চোখকে অবাক হতে হল ম্যাগাজিনের পাতার উপর সেই লোকের চোখ দেখে, তাকানো সরলতা দেখে মেয়ে পড়ছে আর অপেক্ষা করছে লোকটার জন্য আর একটু কি থেমে থেমে পড়া উচিত? বুঝতে পারছে সব কথার মানে? ডিকশনারি মানে জানে? মেয়ের ইচ্ছে করল বুঝিয়ে বলে ডিকশনারি মানে শব্দের আলমারি এর মানে ওটা, তার মানে সেটা

মেয়েকে নামতে হল যে সব কারণে নেমে পড়তে হয় তারই কোন একটার জন্য ফিরতে ফিরতে মনে পড়ছিল ভদ্র মুখেদেরব্যাগেদেরজুতোদের তাদের চরিত্র বদলান ভাবতে ভাবতে শিউরে উঠল কি? মুখোশ খুলে যাওয়া মুখেদের দেখতে দেখতে কেঁপে উঠল?

ঘুমিয়েছিল বোধহয় স্বীকৃতি দেওয়া যায় না বলেই তো ঘুমের কথাদের আমরা স্বপ্নই বলি সেইরকমই কিছু একটা হবে মেয়ে দেখল সেই কাদা পায়ের লোক হেঁটে যাচ্ছে যেসব শব্দগুলোকে তার জন্য কঠিন মনে হয়েছিল সেই কথাদেরই নিয়ে হাঁটছে লোক কাগজ থেকে বেরিয়ে এসেছে শব্দের নদী সেই অবহেলার ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এল শব্দের আলমারি নদীর পাড়ে নতুন, নতুন জামা পরে শব্দেরা ছুটছে, তাদের পায়ে কাদা লেগে যাচ্ছে

শিল্পী - সম্বিত বসু



শিল্পী
-সম্বিত বসু

এমা ছিঃ! ওখানে হাত দিচ্ছেন ক্যানো? একি গে নাকি! আ-আ-আমি কিন্তু ওরম নই। উ মা গো-ও!  বিচিতে মেরে দিল রে! কি পেয়েছেন কি বলুন তো? কে ঢুকতে দিল আপনাকে? দরজা তো বন্ধ। এইভাবে সোজা বিছানায়! জানতাম ট্রেনে মেট্রোতে আজকাল অল্পসল্প এরম কেস হচ্ছে। শুনুন, আমার প্রেমিকা আছে। এতো পুরকি নেই। আরে দেখছেন তো, এত ঘুম ডানচোখটা খুলতেই পারছিনা! আপনি যাবেন কিনা! বাবা গো...

উফফ! চোখে একেবারে! কি চান? ভাগ্যিস, চোখটা বোজা ছিল! আহ। এইতো খুলতে পেরেছি। আমি চেঁচাতে পারছিনা ক্যনো বলুন তো? আপনি কিন্তু একজন রেপিস্ট।

 উলটোদিকের লোকটা একটা আয়না ধরল সামনে। আমার মাথার চুল নেই। কান নেই। ভুরু, চোখের পাতা নেই। হাতদুটো এখনো জোড়া হয়নি বাকি শরীরটার সঙ্গে।

----চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো। টুকরোগুলো কুড়িয়ে পেয়েছি। জুড়ছি এখন!

ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠলাম যখন, ভাবছিলাম‌ মাঝপথে মা ডাকলে, ভদ্রলোক কি চলে যেতেন! আমিও কি উঠে পড়তাম তড়িঘড়ি, অসম্পূর্ণ?