Sunday 27 October 2013

কবীরা - অনিমিখ পাত্র



কবীরা
-অনিমিখ পাত্র

    অনেকদিন বাদে কবীরার দেখা পেলাম। অথচ একটা সময় ছিল যখন তাকে অন্ধের মতো ফলো করাই ছিল আমার কাজঅবশ্য ফলো শব্দটা বোধহয় ঠিক হল না। অন্ধরা ফলো করে না। অনুধাবন করতে করতে যায়। অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের ভলিয়ুম বাড়িয়ে তুলে তারা বুঝতে বুঝতে যায়। তাদের মনোযোগ আমাদের থেকে বেশি। হ্যাঁ,এইবার ঠিক হল- কবীরার প্রতি আমার ছিল মনোযোগ। তখন আমি সিগারেট খেতাম না। মদ খেতাম না। এখন অনেক দায়িত্ব হয়েছে আমার। কবীরাকে কবিতার ছলশব্দ ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। কবিতার সঙ্গে তার তেমন কোনো অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক নেই। কবিতা তো আগেও ছিল।

    ব্যাঙ যেমন প্রায় গোটা শরীরটা জলের ভেতরে রাখে, শুধু চোখসমেত মুন্ডুর সামান্য অংশ জলের ওপর হাওয়ামহলে, কবীরা তেমনি করে চারপাশের দুনিয়া ও আমার জীবনটাকে দেখে। তার সঙ্গে যখন ঘোরাঘুরি করি আমি, তার জলের জগতে, আস্তে আস্তে অন্য সব শব্দের প্রাণ কমে যেতে থাকে আমার কাছে। যেন টিভি উচ্চগ্রামে চলতে চলতে মিউট হয়ে গেছে। বা অনেকটা ঐ সাসপেন্স মুভির মতো,রহস্যের তুঙ্গ মুহূর্তে, যখন কিছু একটা তুল্যমূল্য ঘটবে ঘটবে করছে, নায়ক পা দিতে যাচ্ছে কোনো ফাঁদে, চারদিক থমথম করছে, ভয় বাড়ছে একটু একটু করে, বিপদ আছে কাছেপিঠেই ওৎ পেতে কোথাও কিন্তু কিছু আপাতচোখে ধরা পড়ছে না, তেমন সময়ে যেমন একটা গুম্‌ম্‌ম্‌ গুম্‌ম্‌ ... ভোঁতা একটা ঢিবঢিবে একটা আবহসুর দেওয়া হয়। আমি সমস্ত শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু আমার মনোযোগ তো কবীরার কাছে। এই যে এতোরকমভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছি, সে আমাকে অনেকবার বারণও করেছে। রাগারাগিও করেছে বই কি! সে বলে, মাটির শক্ত মানুষেরা হাওয়ার ফুরফুরে মানুষেরা কী করে বুঝবে তোমার কথা! তারা তো কেউ আমাকে দেখেনি! তুমিই না হয় তাদের দিক থেকে, তাদের যুক্তি দিয়ে একটু ভেবে দেখার চেষ্টা করো। এই যে এতো অন্ধ অন্ধ করো, উপমা দাও, তুমি কি সত্যিই কখনও বুঝবে অন্ধ কেমন করে তার জীবনটাকে দেখে? রাস্তাঘাটের মানচিত্র তার কাছে ঠিক কিরকম? তার দৃষ্টি নেই বলে তার আর কি কি নেই আর কি কি আছে? আর তাছাড়া তুমি নিজেই তো মধ্যে মধ্যে দীর্ঘকাল আমার থেকে দূরে থাকো, মনেই করো না, তাহলে? কবীরাকে সম্ভবত ঈষৎ অভিমানী দেখায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে আবার বলতে থাকেঃ আচ্ছা, বলো তো,এই যে তোমরা এতো বুক বুক করো... কি না, বুকের ভেতরে আবেগ জমে আছে... সত্যিই বুঝতে পারো বুকের ভেতরকে? বুকেরই ভেতর সবসময় থাকে আবেগ? কতো ভেতরে? তা, ডাক্তারেরা ধরতে পারে না কেন? আমি আর কিই বা বলবো, শুধু ঠাহর করতে পারি কবীরা আমাকে ক্রমশ জাঁকিয়ে ধরছে। সে বলে, আমি সবসময় তোমাকে লক্ষ্য রাখি। তুমি জানবে, তোমার যখন আমার কথা মনে পড়ে না, দীর্ঘকাল ভুলে যাও জলের জীবন, তুমি জানবে তুমি শুধু পালিয়ে থাকতে পারো মাত্র। আমি কিন্তু আছি। তুমি বড়জোর চ্যানেল পালটে ফেলোকবীরার কথাগুলোর শব্দমাত্রা কমতে-বাড়তে থাকে আমার কানে। দূর থেকে ভেসে আসা পুজোর মাইকের ঘোষণার মত। দম্‌কা হাওয়ায় তার ঘোষণা ডেসিবেল বাড়িয়ে ফেলে। আমি বলি, তুমি এমনভাবে বলছো কবীরা, যেন তুমি আমার গাইডিং স্টার, যেন আমার গার্ডিয়ান এঞ্জেল! তুমি তো জলের প্রাণী কবীরা! এসব তো তুমি নও! কবীরা হাসে। আমাকে এবার কথাগুলো বলতেই হবে এমন একটা জন্তু আমার মধ্যে ঠেলা মারে, আমি আরো অনেকের কবীরা! আমি যদি লেখাপড়া না শিখতাম,তুমি পেতে এসব কনসেপ্ট? তুমি জলেরই প্রাণী কবীরা। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।আমি জানি তুমি আমাকে অক্সিজেন নিতে দেবে। তবু এই গলা অবধি জলের ভেতর থাকতে থাকতে আমার শরীরে পচন ধরবে কবীরা। শ্যাওলা জমবে গায়ে। আমার ত্বক অন্ধ হয়ে যাবে। আমি বরং সাঁতার দিই,কবীরা, সাঁতার তো আমি জানিআমি সাঁতার দিতে থাকি। কবীরার চিৎকার শুনতে পাই পেছন থেকে, কেন তুমি মানুষের কাছে আমাকে ভিলেনের মত দেখাও? তুমি তো জানো আমি তা নই! তাকিয়ে দেখো তো! কেন অতো বোঝানোর চেষ্টা করো যে তুমি আর কবীরা এক নও ... ...  আমি প্রাণপণ সাঁতার দিতে থাকি। আপাতত এই সাঁতারই আমার গাইডিং স্টার। আমার গার্ডিয়ান এঞ্জেল। মাটিতে হাওয়ার পাড়ে পৌঁছবো কিনা জানি না। পেছন ফিরে দেখতে ভয় হয়। কিরকম দেখবো তার মুখ কে জানে! যদি মায়া হয়। স্মৃতি সততই সুখের- যদি সত্যি মেনে নিই!

হ্যাপি প্রিন্সেস - সাঁঝবাতি


হ্যাপি প্রিন্সেস
-সাঁঝবাতি

কুসুম
ভালবাসবো...
বলে কেউ মোমআলো জ্বালেনি কখনো
আমাকে জ্বালার মত যথেষ্ট অন্ধকার কারুর ছিল না...

সব অন্ধকার মাত্রই আলো জ্বালা যায় না। আমরা দুজন এক গা অন্ধকার নিয়ে আলো খুঁজে চলি। একজন খোঁজে ভালো আরেকজন খোঁজে বাসা। এদের মাঝখানে এক তেপান্তর শূণ্যতা থাকে। একজন মশারী টাঙানোর পার্টনার খুঁজে যায়, আরেকজন নিজেকে। বলেছিলাম, তোর সবচেয়ে ভালো ছবিটা আমিই তুলে দেবো। ক্যামেরায় চোখ রাখি। একা একা করতে করতে তোর যোনিতে জং লাগে, জংলাতে এসে একটা শিবলিঙ্গ রেপ করে যায়। নাহ্‌ বীর্যপাত হয় না। বীর্যপাত তো আমারও হয় না।  আমার কেবল নাইট ফল্‌স আছে। ঘুমের ঘোরে ধপ্‌ করে মাটিতে পড়ে যাওয়া। মাটির কাছাকাছি আসা মানেই তো কোল খোঁজা। খুঁজে পাই না, খুঁজে পাই না...মায়ের মত ভালো গান বাজতে থাকে।
আমি তোর থেকে নাইট্রোসান টেন শিখি। ক্যামেরায় চোখ রেখে দেখি, তুই লাল জামা পড়া মেয়েটার হাত ধরে বিছানায় ধুকে যাস অথবা লোমওলা ছেলেটার বুকে। ওহ্‌ ঘুম, তুমি অর্ধনারীশ্বর। কুসুম, মন নেই বলেই তোমার শরীরের সবচেয়ে সুন্দরী ছবিটা ক্যামেরায় ধরে রাখতে পারলাম; মন থাকলে তোমায় ধরতে গিয়ে, গলার ইভস্‌ অ্যাপেল কেঁপে যেত।   



 কৃষ্ণকলি
দেখেছিলাম আলোর নিচে : অপূর্ব সে আলো
 স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার,  পুড়িয়ে দিলো চোখ...

মনে আছে, আমরা সিটিসেণ্টারে যেতাম?  তার পাশে পলাশগাছটা কি আজও আছে? নাকি কৃষ্ণচূড়া ছিল? ঠিক মনে পড়ে না কারণ আমরা দুজন পা রাখা মাত্রই সমস্ত গাছগুলো লাল হয়ে যেত লজ্জায়। সেই লাল কখনও উঠে আসে সিঁথিময় তারপর ফোলাফোলা চোখে...লালেরা একই থাকে খালি জায়গা আর সময় বদলে যায়।
টুইঙ্কল খান্নাকে কেন টিকটিকি বল্‌তাম আমরা, সেই নিয়ে তুই তোর ফরসা বয়ফ্রেন্ডের সাথে হাসাহাসি কর্‌লি। সেই বয়ফ্রেন্ডের সাথে তোর লালপ্যান্টির সম্পর্ক বেশিদূর গড়ায় না। আমিই গড়িয়ে গড়িয়ে নিচের দিকে নামতে থাকি। তোর কালো বরের সাথে বিয়ে হল। তুই মুখভর্তি ফাউন্ডেশ্‌ন, সাদা পাউডার ঘসে হাঁটাহাঁটি করিস সিটিসেণ্টারে।  
আমার গায়ে আগে কত হীরে জহরত আলো ছিল। আমার লাল নাইটিঙ্গেল পাখি একে একে সবাইকে  আমার গা খুবলে, মাংস খুবলে, সুখ খিদে ভাগ করে দিয়ে আসে। লোকে বলে কেন আমার মুখে এত দাগ? কেন আমি ওগুলো অপারেশ্‌ন করাই না? এখন আমি এদের কি করে বোঝাই, পুরনো সুখগুলো কলঙ্ক হয়ে ফুটে আছে চাঁদে। কুছ দাগ; হুম, আচ্ছা হ্যায়। নাইটিঙ্গেলকে বলি, গাবলুস, যাও এই চোখটা উপড়ে নিয়ে ওর কাছে দিয়ে এসো। ওর এবার আলো দরকার। এতদিন বেচারী চাপচাপ অন্ধকার খেয়ে গা ভর্তি কালো নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কালোরঙের জন্যে ওর ঘেন্না দেখলে মায়া হয়।  
নাইটিঙ্গেল বলে, তোর খালি এই একটাই চোখ বেঁচে আছে। কপাল থেকে তিননম্বর চোখটাও খুবলে নিলে অন্ধ হয়ে যাবি। ওকে বলি, মুগ্ধ হয়ে জ্বলে মরে যাওয়ার চেয়ে অন্ধ হয়ে যাওয়া ভালো। নাইটিঙ্গেল শেষ হীরেটাও উপড়ে এনে তোর কাছে দিয়ে আসে (যদিও সিনেমাটিক, তবুও মণিরত্নম...কারণ যশ চোপড়া হতে গেলে হাজার হাজার ওয়াট হতে হয় )কিন্তু আমি তখনও দেখতে পাই। আমার চোখের সামনে ধ্যাবড়া মোটা সাদা ফ্যাকফ্যাকে একটা আঁশটে টিকটিকি ফটফট করে উপর দিকে উঠে যাচ্ছে। মুখের মধ্যে অর্ধেক ওগড়ানো একটা পুরুষ মানুষের ঠ্যাং। প্রেমে অবৈধতায় না ঘেন্নায় বুঝে উঠতে পারি না। আমার ওয়াক উঠে আসে...     


ঘোলাজল - নীলাদ্রি বাগচী


ঘোলাজল                
-নীলাদ্রি বাগচী

খণ্ডাংশের কাছে উৎসমুখ চেয়ে চলেছে সারাজীবন। ভাঙা আয়নায় দাড়ি কাটতে কাটতে এইটেই বারবার মনে হয়। তখন বাথরুমের জলের আওয়াজ আর রান্নাঘরের নানারকম থেকে কান উঠে যায়। মন যেন গিয়ে দাড়ির গোরায় আসলে সময়ের স্বল্পতায়। এর পর স্নান তার পর খাওয়া আর তারও পর। এইসব ভানায় আটকে যায় জলের আওয়াজ রান্নার নানারকম।

বালতি থেকে মাথায় জল ঢাললেই ঘোলা বাল্বের বাথরুম সাদাকালো টেলিভিশন। চুন বালি খসা সিমেন্ট বাঁধানো দেয়াল চোখের সামনে, গলায় বেসুরো দু এক লাইন। খানিক উহুহুহু হুস উহুহুহু। আর ঝপ ঝপ জলের আওয়াজ। সাদাকালো জলের অবিরল ততক্ষণ যতক্ষণ না শরীর আধভেজা রেখে পোশাক চড়ান। তারপর পৃথিবী আবার রঙিন। কিন্তু ঠিক মানুষটা যেন নেই।

মানুষটা সামান্য ওপরে সিলিং ফ্যান আর ধোঁয়া টেবিলের মাঝামাঝি চিত উপুড় ভাসতে ভাসতে দেখছে টেবিল সে খাচ্ছে। চেষ্টা করছে তাড়াতাড়ি, হচ্ছে নাগরমে মুখ পুড়ে যাচ্ছে। সে ভেসে ভেসে ফিরে যাচ্ছে অতীত। দাড়ি কাটা দেখছে, স্নানের জলের ছিটে লাগছে তার গায়ে। হাতায় মুখের জল মুছে সে ভাসতে ভাসতে আবার খাবার দৃশ্যে। তারপর বাইরে।

একবারে ভবিষ্যতে। যখন সে আবার ফিরে এসে থিতু হল জানলার পাশের মানুষে। বাস চলছে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে। ড্রাইভার কন্ডাক্টরর অভ্যাস হয়ে গিয়েছে এই ঢিক ঢিক। লোক গাল দিক না দিক একই গতি। মেঘলা, গুমোট দিন। এতক্ষণে শিয়ালদা।

গয়নার দোকান বললেই বউবাজার। সারসার কাচে অজস্র। সে আবার ভেসে যায় কাচের পাশে পাশে। এত গয়না মানে কত মানুষ? কত কত কত মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ছে এই সব ঝিলিক। কত আয়নায়। কত চোখেই না ঝলমল করে উঠছে রূপ। রূপ না রূপের মোহ? স্বর্ণতৃষা?

সেন্ট্রাল এভিনিউ এলে আবার ফিরে আসে। দ্রুত হাঁটা ব্যস্ত রাস্তা। লেবুজল বিক্রি হচ্ছে। কাটা ফল। হরেকরকম। একেবারে কোণে ফুটপাথ ঘেঁষে জমা বর্ষার জলে শহর দেখছে শহরকে। কখন যেন মোড় ফুরল। আর ভাঙা চোরায় ঠোক্কর খেতে খেতে বাস ঠেকল কর্পোরেশনর সামনে। ওই তো ওরা দাঁড়িয়ে রয়েছে সব্বাই, সাদাকালো প্রেক্ষাপটে একঝাঁক উজ্জ্বল।


মাঝরাতে এতক্ষণে সে আবার ফিরল। মনে পড়ল তারপর চ্যাপলিনে ছিল রুদালি।