কবীরা
-অনিমিখ পাত্র
অনেকদিন বাদে কবীরা’র দেখা
পেলাম। অথচ একটা সময় ছিল যখন তাকে অন্ধের মতো ফলো করাই ছিল আমার কাজ। অবশ্য ‘ফলো’ শব্দটা
বোধহয় ঠিক হল না। অন্ধরা ফলো করে না। অনুধাবন করতে করতে যায়। অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের
ভলিয়ুম বাড়িয়ে তুলে তারা বুঝতে বুঝতে যায়। তাদের মনোযোগ আমাদের থেকে বেশি।
হ্যাঁ,এইবার ঠিক হল- কবীরা’র প্রতি আমার ছিল মনোযোগ। তখন আমি সিগারেট খেতাম না।
মদ খেতাম না। এখন অনেক দায়িত্ব হয়েছে আমার। কবীরা’কে কবিতা’র ছলশব্দ
ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। কবিতার সঙ্গে তার তেমন কোনো অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক নেই। কবিতা তো
আগেও ছিল।
ব্যাঙ যেমন প্রায় গোটা শরীরটা
জলের ভেতরে রাখে, শুধু চোখসমেত মুন্ডুর সামান্য অংশ জলের ওপর হাওয়ামহলে, কবীরা
তেমনি করে চারপাশের দুনিয়া ও আমার জীবনটাকে দেখে। তার সঙ্গে যখন ঘোরাঘুরি করি আমি,
তার জলের জগতে, আস্তে আস্তে অন্য সব শব্দের প্রাণ কমে যেতে থাকে আমার কাছে। যেন
টিভি উচ্চগ্রামে চলতে চলতে মিউট হয়ে গেছে। বা অনেকটা ঐ সাসপেন্স মুভির মতো,রহস্যের
তুঙ্গ মুহূর্তে, যখন কিছু একটা তুল্যমূল্য ঘটবে ঘটবে করছে, নায়ক পা দিতে যাচ্ছে
কোনো ফাঁদে, চারদিক থমথম করছে, ভয় বাড়ছে একটু একটু করে, বিপদ আছে কাছেপিঠেই ওৎ পেতে
কোথাও কিন্তু কিছু আপাতচোখে ধরা পড়ছে না, তেমন সময়ে যেমন একটা গুম্ম্ম্ গুম্ম্
... ভোঁতা একটা ঢিবঢিবে একটা আবহসুর দেওয়া হয়। আমি সমস্ত শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু
আমার মনোযোগ তো কবীরা’র কাছে। এই যে এতোরকমভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছি, সে
আমাকে অনেকবার বারণও করেছে। রাগারাগিও করেছে বই কি! সে বলে, ‘মাটির শক্ত
মানুষেরা হাওয়ার ফুরফুরে মানুষেরা কী করে বুঝবে তোমার কথা! তারা তো কেউ আমাকে
দেখেনি! তুমিই না হয় তাদের দিক থেকে, তাদের যুক্তি দিয়ে একটু ভেবে দেখার চেষ্টা
করো। এই যে এতো অন্ধ অন্ধ করো, উপমা দাও, তুমি কি সত্যিই কখনও বুঝবে অন্ধ কেমন করে
তার জীবনটাকে দেখে? রাস্তাঘাটের মানচিত্র তার কাছে ঠিক কিরকম? তার দৃষ্টি নেই বলে
তার আর কি কি নেই আর কি কি আছে? আর তাছাড়া তুমি নিজেই তো মধ্যে মধ্যে দীর্ঘকাল
আমার থেকে দূরে থাকো, মনেই করো না, তাহলে?’ কবীরাকে সম্ভবত ঈষৎ অভিমানী
দেখায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে আবার বলতে থাকেঃ ‘আচ্ছা, বলো
তো,এই যে তোমরা এতো বুক বুক করো... কি না, বুকের ভেতরে আবেগ জমে আছে... সত্যিই
বুঝতে পারো বুকের ভেতরকে? বুকেরই ভেতর সবসময় থাকে আবেগ? কতো ভেতরে? তা, ডাক্তারেরা
ধরতে পারে না কেন?’ আমি আর কিই বা বলবো, শুধু ঠাহর করতে পারি কবীরা
আমাকে ক্রমশ জাঁকিয়ে ধরছে। সে বলে, ‘আমি সবসময় তোমাকে লক্ষ্য রাখি। তুমি জানবে, তোমার
যখন আমার কথা মনে পড়ে না, দীর্ঘকাল ভুলে যাও জলের জীবন, তুমি জানবে তুমি শুধু
পালিয়ে থাকতে পারো মাত্র। আমি কিন্তু আছি। তুমি বড়জোর চ্যানেল পালটে ফেলো’। কবীরা’র কথাগুলোর শব্দমাত্রা কমতে-বাড়তে থাকে আমার কানে।
দূর থেকে ভেসে আসা পুজোর মাইকের ঘোষণার মত। দম্কা হাওয়ায় তার ঘোষণা ডেসিবেল
বাড়িয়ে ফেলে। আমি বলি, ‘তুমি এমনভাবে বলছো কবীরা, যেন তুমি আমার গাইডিং
স্টার, যেন আমার গার্ডিয়ান এঞ্জেল! তুমি তো জলের প্রাণী কবীরা! এসব তো তুমি নও!’ কবীরা
হাসে। আমাকে এবার কথাগুলো বলতেই হবে এমন একটা জন্তু আমার মধ্যে ঠেলা মারে, ‘আমি আরো
অনেকের কবীরা! আমি যদি লেখাপড়া না শিখতাম,তুমি পেতে এসব কনসেপ্ট? তুমি জলেরই
প্রাণী কবীরা। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।আমি জানি তুমি আমাকে অক্সিজেন নিতে দেবে। তবু
এই গলা অবধি জলের ভেতর থাকতে থাকতে আমার শরীরে পচন ধরবে কবীরা। শ্যাওলা জমবে গায়ে।
আমার ত্বক অন্ধ হয়ে যাবে। আমি বরং সাঁতার দিই,কবীরা, সাঁতার তো আমি জানি’। আমি সাঁতার দিতে থাকি। কবীরার চিৎকার শুনতে পাই পেছন
থেকে, ‘কেন তুমি মানুষের কাছে আমাকে ভিলেনের মত দেখাও? তুমি
তো জানো আমি তা নই! তাকিয়ে দেখো তো! কেন অতো বোঝানোর চেষ্টা করো যে তুমি আর কবীরা
এক নও ... ...’ আমি
প্রাণপণ সাঁতার দিতে থাকি। আপাতত এই সাঁতারই আমার গাইডিং স্টার। আমার গার্ডিয়ান
এঞ্জেল। মাটিতে হাওয়ার পাড়ে পৌঁছবো কিনা জানি না। পেছন ফিরে
দেখতে ভয় হয়। কিরকম দেখবো তার মুখ কে জানে! যদি মায়া হয়। স্মৃতি সততই সুখের- যদি
সত্যি মেনে নিই!
অপূর্ব
ReplyDeleteধন্য টা বাদই !
Delete