অসুস্থ জানলা
-রোহণ ভট্টাচার্য
বাইরে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। কাঁচের
জানলা। সামান্য শব্দটুকুও বেরোতে পারবে না বাইরে। যদি আলো হয় তবে কাঁচ ভেদ করে
বাইরের উঠোন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত। অথচ এইসময়, ঠিক এইসময় আলোহীন শব্দই লিখতে ইচ্ছে
করে ওর। ঘরের ছাদ থেকে বইয়ের তাক পর্যন্ত ধুলো। ধুলো সরিয়ে শব্দটা খুঁজে পেতে হবে।
তোষকের নিচে বা বইয়ের ভাঁজে কোথাও একটা লুকিয়ে আছে শব্দটা। সেই নীল হরফের শব্দ সারা গায়ে একটা সাদা কাগজ জড়িয়ে
ঘুমিয়ে আছে এই ঘরের মধ্যে। দরজা-জানলা বন্ধ তাই উড়ে পালাতে পারেনি কোথাও।
জানলার ওপাশে গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ছে। বৃক্ষজীবন ত্যাগ করে একেকটা পাতা এগিয়ে
চলেছে মাটিজীবনের দিকে। গাছ থেকে ছিঁড়ে মাটি অবধি যাওয়ার সময় পাতাদের জড়িয়ে ধরে
আদর করে হাওয়া। এলোমেলো হাওয়ার শরীরে পাতারা ভরে দেয় খসে পড়ার গান। সেই থেকে সকল খসে পড়া, সকল
চলে যাওয়ারা হাওয়ার সন্তান। সদ্য জন্মানো শিশু যেমন কেঁদে কেঁদে মাকে ডাকে; ঠিক সেইভাবে
বিচ্ছেদ জন্মালে তার কান্না দীর্ঘশ্বাস হয়ে হাওয়ার কাছে যায়। ঘরের ভেতর এইসময়
ডাইরির পাতারা নড়ে ওঠে। একবার সেলাই খুলে ছিটকে আসতে পারলেই দুপাশের পৃষ্ঠা দুটো
মেলে দেবে পাখির ডানার মতো। অথচ তারা বেশিদূর উড়তে পারে না। অক্ষরের ভারে অকেজো
হয়ে গেছে ডানা। হয়ত উড়ে যাওয়া বিষয়ক কিছু একটাই লেখা ছিল সে পৃষ্ঠায়...
ঘরের ভেতর, কাঁচের এপাশে হারিয়ে যাওয়া কাগজটা খুঁজছিল যে; এতক্ষণ সে দেখছিল এইসব। দেখছিল
ওপাশে কিছু দূরে আরেকটা জানলা। সেই জানলায় মেঘ আসত না। কিন্তু মেঘের রাজ্য পেরোলে যে দেশ সেখান থেকে
টেলিগ্রাম আসত আর আসত একটা চড়ুই পাখি যার পায়ে বেঁধে রোদ্দুর চিঠি পাঠাত ওই
জানলায়। এপাশের জানলা থেকে সে বহুবার বলতে চেয়েছে
আমার চিঠি নেই। সারাবছরের অসুখ আছে।
পুরোনো অসুখে জমানো ধূলো আছে ঘরময়। সেই ধূলোর গায়ে আঙুল বুলিয়ে আমি জানলা জুড়ে
স্মাইলি আঁকছি তোমার জন্য।
ওর জানলা দিয়ে এয়ারপোর্ট দেখা যায় না, শুধু উড়ে যাওয়া দু-একটা প্লেন দেখা যায়। প্লেনের ছায়া এসে উল্টোদিকের জানলার কপাটে পড়লে কেমন লাগে দেখার চেষ্টা করে। বাইরে তাকিয়ে ওর মনে হয় যেন একটা গাছ চরিত্রে অভিনয় করছে সে। পাতার বদলে গাল বেয়ে জলের ফোঁটা ছিঁড়ে পড়ছে মাটিতে। আছড়ে পড়ার তীব্র আওয়াজে ভরে যাচ্ছে ঘরটা। তবু কাঁচ ভেদ করে ওপাশে যেতে পারছে না কিছুতেই। প্লেনের দিকে তাকিয়ে ওর মনে পড়ে, ওখানকার কোনো এক যাত্রীর জন্য সাদা কাগজে আলোহীন একটা শব্দ লিখেছিল সে। যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া কালিতে। এখন কোথাও তাকে খুঁজে না পেয়ে জানলার ধুলোয় হাত বুলিয়ে আরেকটা মৃদু হাসিমুখ আঁকল। তারপর আদর করার ভঙ্গিতে কাঁচটা সরিয়ে দিতেই হুহু হাওয়া এসে ধাক্কা খেতে লাগল অসুখের ওপর, ফাঁকা ওষুধের পাতাগুলো ভেসে গেল এদিক ওদিক। বাইরে গাছের গায়ে পিঁপড়েরা তখন আরেকটা নতুন নক্সা আঁকছে।
Bhalo laglo Rohon
ReplyDelete-Alokparna
জানলার ওপাশে গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ছে। বৃক্ষজীবন ত্যাগ করে একেকটা পাতা এগিয়ে চলেছে মাটিজীবনের দিকে। গাছ থেকে ছিঁড়ে মাটি অবধি যাওয়ার সময় পাতাদের জড়িয়ে ধরে আদর করে হাওয়া। - ভারি চমৎকার !
ReplyDelete